ঐতিহ্যগত ভাবেই লাইরিডস উল্কাবৃষ্টি সুপরিচিত। খুব পুরানো উল্কাবৃষ্টিদের মধ্যে এটি একটি। এদের নিয়ে প্রথম হদিস মেলে ৬৮৭ খ্রিষ্টপূর্বের চীনা জ্যোতির্বিদের নিকট। সাধারণত এই উল্কাবৃষ্টি পড়ে মধ্য-এপ্রিল থেকে। তখন এদের পড়ার হার খুবই কম থাকে। এই ধরেন ঘণ্টায় ১টা। তবে যত রাত যায় ততই এই হার বৃদ্ধি পায়৷ আর সবচেয়ে বেশি হয় ২১ তারিখ রাত ১২টার পরের দিন ২২ তারিখ সূয্যিমামা উঠার আগ পর্যন্ত। অতপর আবার এই হার কমতে থাকে। কমতে কমতে ২৫শে এপ্রিলের ভেতরেই চলে যায় ZHR ১ এর নিচে৷
২১,২২,২৩ এপ্রিল এই ৩ দিনই ভালো উপভোগযোগ্য রাত। তবে ২২তারিখ হল আদর্শ। এ সময়েই সর্বোচ্চ লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির দেখা মেলে। ঘণ্টায় ১০ থেকে ২৫টার মতো। তবে ধারণা করা হয় ২০৪০ এবং ২০৪১ সালে খুবই অল্প সময়ের জন্য এই উল্কাবৃষ্টি প্রতি ঘণ্টায় ১০০টিরও বেশি উল্কা দেখবার সুযোগ করে দেবে। এমন বেশি হারের ঘটনা প্রায় ৬০ বছর পর পরই ঘটে থাকে। ১৮০৩ সালে এদের বর্ষণ হার এত বেশি ছিল যে, প্রতি ঘণ্টায় ৭০০টির মতো দেখা গিয়েছিল। বর্ষণ হার অতি বেশি হলে এদের উল্কাঝড় বলা হয়। আবার ১৯৮২ সালে সালে সৌখিন জ্যোতির্বিদরা প্রতি ঘণ্টায় ৯০টির মতো দেখেছিলেন। ১৯২২ সালেও এই হার পরিলক্ষিত হয়।
এই উল্কাবৃষ্টির জননী হলো (C/1861 G1) Thatcher নামের এক ধুমকেতু। প্রফেসর A.E. Thatcher ১৮৬১ সালের ৪ই এপ্রিল এই ধুমকেতু আবিস্কার করেন। সেই সালে আমেরিকানরা এই ধুমকেতুর আবির্ভাব কে অশুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করে। অবশ্য New York Herald অনুসারে সেই বছর একটা সিভিল ওয়ার হবার ঘোষণা হয়। এই ধুমকেতু ৪১৫ বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। শেষবার একে ১৮৬১ সালে প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। পরের বার ২২৭৬ সালের আগে এটি প্রদক্ষিণ করবে না।
লাইরিডস উল্কাগুলো সাধারণত ভালোই উজ্জ্বল হয়৷ এতোটাই উজ্জ্বল যে, এদের বেশিরভাগই ফায়ার বল হবার সম্ভাবনা থাকে। এদের ফায়ার বল খুবই উজ্জ্বল হয়, ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের সুপরিচিত শুকতারা বা শুক্র গ্রহণের থেকেও বেশি। এদের ফায়ার বলের পেছনে প্লেনের মতো দেখতে যে ধোঁয়া ছড়ায় তা কয়েক মিনিট অবস্থান করে।
এটি একটি সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সাপেক্ষে এই উল্কাবৃষ্টি উপভোগ করা যাবে।
নামকরণ
লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির নামকরণ করা হয়েছে মূলত লাইরা (Lyra) বা বীণা মণ্ডল থেকে। যদিও এই উল্কাবৃষ্টির রেডিয়েন্ট মূলত হারকিউলিস মণ্ডলে অবস্থিত। তবে যখন এর নামকরণ করা হয় তখন আসলে আকাশ পটে আমাদের আধুনিক ও নির্দিষ্ট ৮৮টি মণ্ডল ছিল না। এক এক জাগায় এক এক তারার ম্যাপ ছিল। এই উল্কাবৃষ্টির রেডিয়ান্ট যদিও বীণা মণ্ডলের ভেগা বা অভিজিৎ তারার মোটামুটি নিকটে তবে কড়ায়গণ্ডায় তা হারকিউলিস মণ্ডলের সীমানার ভেতরেই অবস্থিত। তবে হারকিউলিস আসলে একটি অনুজ্জ্বল তারকা মণ্ডল এবং এর সীমানাও ঠিক পরিপূর্ণভাবে সুনির্দিষ্ট নয় তাই এই রেডিয়ান্ট বীণা মণ্ডলের বললেও মহাভারত খুব একটা অশুদ্ধ হবে না।
এটা বলে রাখা ভালো যে, হারকিউলিস মণ্ডল অনুজ্জ্বল হওয়ায় আকাশে বীণা মণ্ডলের সাহায্য ছাড়া একে খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। আমরা আকাশে বীণা মণ্ডলকে খুঁজব, সেইসাথে লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির রেডিয়েন্ট কেও খুঁজে বের করব তবে, এর আগে বীণা মণ্ডলের কিছু পুরাণ ও ইতিহাস জানা যাক।
বীণা মণ্ডলের ইতিকথা
আকাশের তারাচিত্রে এখানে একটি হার্পের কল্পনা করা হয়। হার্প হল বীণা জাতীয় একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র। বেশিরভাগ বর্ণনায় দেখা যায় সূর্যদেব অ্যাপোলোর পুত্র আরফিয়াস ছিলেন থ্রেস নগরীর সেরা হার্পবাদক। আরফিয়াস তার পিতা থেকে এই হার্পটি উপহার পান। তিনি এটি এতোই মধুর সুরে বাজাতেন যে, বন্যপ্রাণী থেকে গাছপালা পর্যন্ত তার সুরে স্তব্ধ হয়ে যেত।
পুরাণের এক বর্ণনায় পাওয়া যায় আরফিয়াস তার স্ত্রী কে হারালে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক সুরে গান করেন যে দেবতারাও কাদতে থাকেন। পরে সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যার্থ হলে তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান। আগে তিনি ডায়োনিসাসের পূজক থাকলেও পরে সূর্যদেব অ্যাপোলো বাদে ডায়োনিসাসের পূজা না করায় অপদেবী মেইনাডারার হাতে মৃত্যু ঘটে। তবে তার দেহ হতে আলাদা হয়ে যাওয়া মাথাটি সাভাবিক স্বভাবেই গাইতে থাকে। পরে মাথাটি নদীতে পড়ে গিয়ে এক দিপে গিয়ে পৌছালে সেখানের বাসিন্দারা তাকে মাটি চাপা দিয়ে একটি মন্দির বানান। পরে দেবী মুজেরা হার্পটিকে নিয়ে স্বর্গে গেলে তার সম্মানে এই বাদ্যযন্ত্রকে আকাশের লাইরা মণ্ডল হিসেবে স্থাপন করা হয়।
আর ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় এই মণ্ডলে একটি বীণার কল্পনা করে নাম রাখা হয়েছে বীণা মণ্ডল। সনাতন ধর্মের প্রায় সকলেরই দেবোর্ষি নারদকে জানার কথা। কোনো কোনো বর্ণনা মতে তিনিই বীণা যন্ত্রের উদ্ভাবক। তার প্রিয় এই বীণাটিই যেন রাতের আকাশে আমরা দেখি।
আকাশ পটে বীণা মণ্ডল
এপ্রিল মাসে বীনা মণ্ডল উদিত হয় রাত প্রায় ৯টা ৩০ মিনিটে। উঠার সময় উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়না বললেই চলে। তবে রাত যত গভীর হয় মণ্ডলটিও তত উপরে আসে৷ রাত ৪টা ৪৫ মিনিটে আকাশে এর অবস্থান থাকে সর্বোচ্চ। এর পর আস্তে আস্তে নেমে যায় অস্তের পথে অতপর সকাল ১১টা ৫৮ মিনিটে চলে যায় দিগন্তের নিচে।
সাধারণত রাত ৩ টার পর উল্কাদের বেশি দেখার সম্ভাবনা বেশি থাকে৷ তবে ৪টায় লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির পিক আওয়ার বলা চলে৷ ৪টার দিকে বেশি লাইরিডস উল্কা দেখার সম্ভাবনা থাকে। তবে বীণা মণ্ডল যেহেতু ৯:৩০ এ উঠে আমরা ১০:৩০ থেকেই মোটামুটি এদের ভালোভাবে দেখতে পাব। তবে সোজা কথা, রাত যত গভীর দেখার সম্ভাবনাও তত বেশি।
আপনার অবস্থান থেকে সোজাসুজি উত্তর-পূর্বে তাকালেই দেখবেন বেশ বড় একটা তারা। এটি সেদিকের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। এই তারার নিচের ৪টি তারা দিয়ে একটি সামান্তরিক কল্পনা করা যায়৷ আর এদের নিয়েই বীণা মণ্ডল গঠিত। উক্ত বড় তারার পাশ্চাত্য নাম ভেগা, বাংলায় অভিজিৎ। এই মণ্ডলের উপরে একটু পূর্বেই হারকিউলিস মণ্ডল অবস্থিত। তবে আমাদের রেডিয়েন্ট হল, অভিজিৎ থেকেই একটু পূর্বে। অভিজিৎ থেকে সোজা পূর্বে আপনার এক আংগুল পরিমাণ একটি সরল রেখাই হল লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির রেডিয়েন্ট পয়েন্ট। নিচে একটি ছবি দিয়েছি স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ ম্যাগাজিনের, সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন বলে আশাকরি।
হ্যাপি উল্কাবৃষ্টি দেখা।