মুক্তিবেগের গল্প
১। মর্ত্যের মানুষ চিরকালই স্বাধীনচেতা। তাইতো তারা পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায়নি। তাইতো কাল্পনিক পুরাণেও মুক্ত ইকারাস উড়তে উড়তে চলে গিয়েছিল সূর্যের কাছাকাছি। নিউটন এসে যেন কারার ঐ লৌহ কপাট ভাঙার পথ দেখালেন। তার মহাকর্ষ সূত্র ব্যবচ্ছেদ করেই বেরিয়ে আসলো এমন এক বেগের সমীকরণ যার মাধ্যমে পৃথিবীর শৃঙ্খল ভেংগে চিরতরে চলে যাওয়া যাবে। শুধু পৃথিবীর ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র মহাবিশ্বের সমস্ত ভরযুক্ত বস্তুর মহাকর্ষীয় বলকে বুড়ো আংগুল দেখাতে পারে এই বেগ। এই বেগ অর্জন করতে পারলে পৃথিবীও সূর্যকে ছেড়ে চলে যেত অন্য কোথাও, সৌরজগত থেকে অনেক দূরে। এর নাম মুক্তি বেগ বা এস্কেপ ভেলোসিটি।
২। মনে করি, আমি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে একটি পাথরকে ছুড়ে মারলাম, অনেকটা প্রাসের গতিপথের মত। তাহলে কি হবে? পাথরটি একটি নির্দিষ্ট দুরত্ব অতিক্রম করে মাটিতে পড়বে। কারন পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে প্রতি সেকেন্ডে তার বেগ ৯.৮ মি/সে এ কমে আসতে আসতে একসময় শূন্য হয়ে যায় (বাতাসের ঘর্ষণের ফলেও গতিশক্তি কমে যায়), তারপর সে আর উপরে না উঠে নীচের দিকে পড়তে থাকে। এভাবে আমি যদি আরো শক্তি দিয়ে বেশি বেগে পাথরটিকে ছুড়ে মারি তাহলে পাথরটি আরও বেশি দুরত্ব অতিক্রম করবে। উল্লম্ব ও আনুভূমিক- দুই দিকেই। কারণ ৯.৮ মি/সে হারে বেগ কমে শূন্য হতে এবার একটু বেশি সময় নিবে কেননা এবার আদিবেগ বেশি ছিল। এভাবে বেগ বাড়াতে থাকলে দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট আদিবেগে উপরে ছুড়ে মারলে এর বেগ কমতে কমতে শূন্য হওয়ার আগেই এটি মহাশূন্যে পৌছে যায়। মহাশূন্যে পৌছে নিউটনের ১ম সূত্র অনুযায়ী এটি একটি ধ্রুব বেগ পায়। এটি কিন্তু মুক্তিবেগ নয়। তখন এটি সামনে এগুনোর পাশাপাশি মহাকর্ষের প্রভাবে পৃথিবীর দিকেও পড়তে থাকবে। যদি পাথরের সামনে এগুনোর গতিশক্তি পৃথিবীর মহাকর্ষ শক্তির চেয়ে কম হয় তবে এটি একসময় পৃথিবীতে পড়বে। আর যদি সমান হয়ে তবে এটি উপরেও যেতে পারবেনা, পৃথিবীতে পড়তেও পারবেনা, একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় থেকে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকবে। এই বেগকেও মুক্তিবেগ বলেনা, এটা অরবিটাল বেগ। পাথরের বেগ যদি অরবিটাল বেগের সমান হয় এবং পৃথিবী যেহেতু গোলাকার তাই কেন্দ্রবিমুখী ও কেন্দ্রমুখী বল সমান হয়ে পাথরটি একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরবে যেমনটি স্যাটেলাইট ঘুরে। চিত্রের ছবিটি লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে। আদিবেগ যদি আরও বৃদ্ধি করা হয় তাহলে দেখা যায় পৃথিবী থেকে এর কক্ষপথের দুরত্ব আরও বেড়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে এর কক্ষপথ পরাবৃত্ত হবে, আরো বাড়ালে অধিবৃত্ত হবে। আদিবেগ যদি আরো বাড়ানো হয় তবে এটির বেগ কমতে কমতে শুন্য হওয়ার আগেই এটি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে এমন দূরে যাবে যে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল আর এটিকে পৃথিবীতে ফিরে আনতে পারবে না। এটার নামই হচ্ছে মুক্তিবেগ।
৩। এখন রকেটের প্রসঙ্গে আসি। রকেটের নিজস্ব জ্বালানী ও ইঞ্জিন আছে। এটিকে মুক্তিবেগে ছোড়ার কোন মানেই হয়না। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিবেগের সমান আদিবেগে নিক্ষেপ করা মুখের কথা নয়। আমরা আগের উদাহরণে দেখলাম পাথরের গতি ছুড়ে মারার পর মহাকর্ষের প্রভাবে কমতে থাকে। কিন্তু রকেটের কমেনা, কারণ সেটি জ্বালানী ও ইঞ্জিনের মাধ্যমে নিজের বেগ প্রয়োজনমত বৃদ্ধি করে। আর যদি মুক্তি বেগেই পাঠানো হয় তবে কি রকেট আর ফিরে আসবে না? অবশ্যই আসবে। এটি পৃথিবীর কক্ষপথ পার হয়ে অনেকদূরে গিয়ে যদি মনে করে রকেটের অভিমুখ ঘুরিয়ে পৃথিবীর দিকে যাই তাহলেই হল। এটি তো আর পাথরের মত না। এর ইঞ্জিন আছে, কন্ট্রোল প্যানেল আছে, যেদিকে ইচ্ছে সেদিকেই যেতে পারে। তবে রকেট যদি পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদ কিংবা অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে যায় সেক্ষেত্রে তাকে মুক্তিবেগ অর্জন করতে হয়। তবে সেটা কিন্তু ১১.২ কিমি/সে নয়। এর চেয়ে কম। কারণ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে যাওয়া হয় তত মুক্তি বেগ কমতে থাকে। মিশনের শুরুতেই ভূ-পৃষ্ঠের মুক্তিবেগ ১১.২ দিয়ে পাঠানো সহজ কথা নয়। তাই রকেটকে একটি নির্দিষ্ট অরবিটাল বেগসহ একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে ওই কক্ষপথ ত্যাগ করার মত মুক্তিবেগ প্রদান করা হয়। তখন সে কক্ষপথ ছেড়ে গন্তব্যের দিকে রওনা হয়। কোন কক্ষপথের অরবিটাল বেগকে যদি ১.৪১৪ (২ এর বর্গমূল) দিয়ে গুন করা হয় তবে সেই কক্ষপথের মুক্তিবেগ পাওয়া যায়। ধরি একটি রকেট মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করবে। তাহলে তাকে প্রথমে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০ কিমি উচ্চতার লো আর্থ অরবিটে নিয়ে যাওয়া হবে (অন্য অরবিটেও হতে পারে) যেখানে অরবিটাল বেগ ৬.৯ কিমি/সে। সেখানে মুক্তিবেগ হবে ১.৪১৪x৬.৯ = ৯.৭৬ কিমি/সে। তারপর রকেটটির বেগ বৃদ্ধি করে ৬.৯ থেকে ৯.৭৬ কিমি/সে করলেই সে পৃথিবীর মহাকর্ষের শৃঙ্খল ভেঙ্গে চাঁদের দিকে রওনা দিবে।
৪। পৃথিবীপৃষ্ঠের যেমন মুক্তিবেগ ১১.২ কিমি/সে, তেমনি সূর্যপৃষ্ঠের মুক্তিবেগ ৬১৭ কিমি/সে। এই পৃথিবী সূর্য থেকে প্রায় ১৪৯,৫৯৭,৮৭০ কিমি দূরের একটি কক্ষপথে প্রায় ৩০ কিমি/সে বেগে প্রদক্ষিণ করছে। সূর্যের ভর ১.৯৮৯ x ১০৩০ কেজি। মহাকর্ষীয় ধ্রুবক এর মান ৬.৬৭x১০-১১ মি৩/কেজি/সে২ । এই মানগুলি ব্যবহার করে পৃথিবীর কক্ষপথে সূর্যের মুক্তিবেগ (Ve=√(2GM/R) বা Ve=Ve=√2x Orbital Velocity )বের করলে দেখা যায়, পৃথিবীর বেগ যদি ৪২.১২ কিমি/সে হত তবে সে সূর্যের কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে যেত।