সুপারনোভা ও নক্ষত্রের মৃত্যু!
সুপারনোভা ও নক্ষত্রের মৃত্যু:
আমাদের নক্ষত্র সূর্য এখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। সূর্য প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর ধরে এরকম পূর্ণবিকশিত ও স্থিতিশীল অবস্থায় আছে এবং ধারনা করা হয় আরো কয়েক শত কোটি বছর থাকবে। এরকম স্থিতিশীল থাকার কারণ হচ্ছে দুই ধরণের চাপের সাম্যাবস্থা। আমরা এর আগে দেখেছি যে, নক্ষত্রের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময় দুই ধরনের চাপ কাজ করে – মহাকর্ষীয় চাপ যা কেন্দ্রমুখী আর একটি হল নক্ষত্রের কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ ও অন্যান্য শক্তির বহির্মুখী চাপ। যতদিন এই দুই চাপ একে অপরকে ব্যালেন্স বা সাম্যাবস্থায় রাখে ততদিন নক্ষত্রের স্থায়ী রূপ দেখা যায়।
নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় আমরা হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তর ও শক্তি উৎপন্ন হওয়া দেখেছি। কিন্তু এটি আজীবন চলেনা। একসময় সব হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায়। হাইড্রোজেন ফিউশান থেকে তাপ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মহাকর্ষীয় চাপ প্রকট হয় এবং নক্ষত্রটিকে কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত করতে থাকে যার ফলে এর কেন্দ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাপশক্তি যখন পর্যাপ্ত বেড়ে যায় তখন হিলিয়াম ফিউশান শুরু হয়। হিলিয়াম পরমাণুগুলো আরো ভারী ধাতুতে রূপান্তরিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। নক্ষত্রটি আবার বড় হতে শুরু করে এবং বাইরের দিকে তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি হ্রাস হয়। ফলে এটি লাল রঙ ধারণ করে। এই পর্যায়কে বলা হয় লাল দানব বা রেড জায়ান্ট। ক্রমান্বয়ে হিলিয়াম অক্সিজেন নিউক্লিয়াসে, অক্সিজেন কার্বন নিউক্লিয়াসে, দুইটি কার্বন নিউক্লিয়াস মিলে ম্যাগনেসিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। প্রতিটি ফিউশান বিক্রিয়ার শেষে কিছুদিন মহাকর্ষীয় চাপে কেন্দ্র সংকুচিত হয়ে এবং পরের পর্যায়ের শুরুতে নক্ষত্রটি সম্প্রসারিত হয়। একসময় এর বাইরের অংশটি উড়ে যায় তখন একে সাদা দেখায়। এই পর্যায়কে বলে সাদা বামন বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ। কিন্তু একসময় এই ধারাবাহিক বিক্রিয়া শেষ হয়ে যায় যখন লোহা, কোবাল্ট, নিকেলের মত ভারী নিউক্লিয়াস তৈরী হয়। তখন এই নিউক্লিয়ার ফিউশন সম্ভব হয়না, বন্ধ হয়ে যায় নক্ষত্রের শক্তির কারখানা। তখন মহাকর্ষীয় বলের কেন্দ্রমুখী চাপকে বাধা দেয়ার মত কোন কেন্দ্রবিমুখী চাপ থাকেনা। নক্ষত্রটির বিপুল ভর কেন্দ্রে সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে ঘনত্ব বাড়তে থাকে এবং একসময় প্রচন্ড চাপের ফলে নক্ষত্রের পদার্থ যে পরমাণু দিয়ে গঠিত তা থেকে ইলেকট্রন গুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে মুক্ত ভাবে অবস্থান করে। পাউলির বর্জন নীতি অনুযায়ী যেহেতু দুইটি ইলেকট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকতে পারেনা তাই এরা সংকোচনের বিরুদ্ধে বহির্মুখী চাপ সৃষ্টি করে যাকে ইলেক্ট্রন ফার্মি চাপ বলে (যেহেতু ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এরা ফার্মিয়ন ধরণের কণা)।
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রেশেখর অনুযায়ী কোন নক্ষত্রের ভর যদি ১.৪ সূর্য ভরের কম হয় তবে এই ইলেক্ট্রন ফার্মি চাপ মহাকর্ষীয় চাপকে সামলাতে পারেনা। তখন নক্ষত্রটির প্রচন্ড সংকোচনে ঘটে এবং ইলেক্ট্রনগুলো কেন্দ্রে প্রোটনের উপর আপতিত হয়। তখন এটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয়। যদি নক্ষত্রটির ভর ৬ সূর্য ভরের চেয়ে বেশি হয় তখন নিউট্রন ফার্মি চাপও মহাকর্ষীয় সংকোচনকে আটকাতে পারেনা। ফলে আরও প্রচন্ড সংকোচন হয় ও গতিশীল তাপ সৃষ্টি হয়ে বাইরের অংশটির বিস্ফোরণ ঘটে যাকে সুপারনোভা বলে। এই বিস্ফোরণের আলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। ভর কম হওয়ায় আমাদের সূর্যের কখনো সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটবেনা। সূর্য প্রথমে লাল দানব হবে এবং খুব সম্ভবত পরে শ্বেত বামনে পরিণত হবে।
তথ্যসূত্রঃ কৃষ্ণবিবর- ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম, নাসা ওয়েবসাইট